সাহিত্য মানেই হচ্ছে কল্যাণের সম্মিলন। এই সম্মিলন আসমান, জমিন, সমুদ্র, পাহাড়, আলো আর ছায়াবিথীর সম্মিলন। এই সম্মিলনে আছে সুখ, আছে সফলতার পাথেয়। এই পাথেয় যেমন দুনিয়ার, তেমনি পরকালেরও। পৃথিবীর প্রতিটি সাহিত্যভা-ারের মতো আমাদের বাংলা সাহিত্যও একটি উৎকর্ষিত সাহিত্যভা-ার। এই ভা-ারেও রয়েছে পার্থিব বা আধ্যাত্মিক চেতনার ঢেউ। রয়েছে ইসলামের বিধিবিধান সংক্রান্ত অনেক কিছুই। যা ভুলে ভরা জীবন আকাশের অন্ধকার মজিয়ে এঁকে দেয় ভোরের সূর্য। প্রকৃতি-মানুষ, তাদের নানান কথা যেমন ফুটে উঠেছে এই সাহিত্যের অক্ষরে অক্ষরে তেমনি সেই অক্ষরের মিছিলে মহররম, আশুরা, ঈদ নিয়েও খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিকরা লিখেছেন নানান গল্প-প্রবন্ধ, ছড়া-কবিতা। তবে যে কথাটা আফসোসের সাথে বলতে হয়, তা হচ্ছে রমজান। রমজান নিয়ে বাংলা সাহিত্যে ততোটা লেখা হয়নি। যতোটা হয়েছে অন্যান্য বিষয়ে। তবে একেবারে যে হয়নি তা কিন্তু নয়। এই যেমন, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘কেন জাগাইলি তোরা’ শীর্ষক কবিতায় মাহে রমজানকে তুলে ধরেছেন এক মমত্ব প্রজ্ঞায়। তিনি লিখেছেন, ‘মাহে রমজান এসেছে যখন আসিবে ‘শবে কদর/ নামিবে রহমত এই ধূলির ধরার পর/এই উপবাসী আত্মা এই যে উপবাসী জনগণ/চিরকাল রোযা রাখিবে না আসে শুভ এফতার ক্ষণ’।
কবি তাঁর এই কবিতার শেষাংশে সুফিত্বের সবক দিয়ে লিখেছেন, ‘আমি দেখিয়াছি- আসিছে/তোদের উৎসব- ঈদ-চাঁদ/ওরে উপবাসী ডাক তাঁরে ডাক/তাঁর নাম লয়ে কাঁদ।’
উপবাসী বলে কবি যে এখানে রোযাদারকেই বুঝিয়েছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রমজান উঠে এসেছে প্রাবন্ধিকদের কলমের আচরেও। তারা ফুটিয়ে তোলেছেন দু’বেলা দু’মুঠো খেতে না পারাদের ক্ষুধার জ্বালা। তারা জানিয়ে দিয়েছেন, পবিত্র রমজান অভাবহীনদের এই শিক্ষাই দেয়, সমাজের দারিদ্র, পীড়িত, ক্ষুধাতুরদের অবস্থা অনুধাবন করে, তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে। তাদের সাথে সহানুভূতি ও মমত্ববোধের সেতুবন্ধন তৈরি করতে। এমনই দরদমাখা বয়ান করেছেন অধ্যাপক শাহেদ আলী তাঁর ‘রমাজানের শিক্ষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আল্লাহর অস্তিত্বকে জীবনে সত্য ও বাস্তব করিয়া তোলার সঙ্গে সঙ্গে রমজান সামগ্রিক দায়িত্বের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। রমজানের রোজা রাখিয়া ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর মুসলমান প্রত্যক্ষভাবে বুঝিতে পারে, অভাবের দরুণ যারা উপবাস করে তাদের কী কষ্ট’।
প্রখ্যাত রাজনীতিবীদ ও সাহিত্যসাধক আবুল মনসুর আহমদও তাঁর ‘রোজা ও ঈদ’ শিরোনামের নিবন্ধে এমনই ইঙ্গিত দিয়ে লিখেছেন, ‘কি কঠোর কৃচ্ছ্রতা ও সংযম সাধনা। একটানা ৩০ দিনের উপবাস। দিনে রোযা আর রাতে ইবাদত। ইন্দ্রিয়রা সবাই শৃঙ্খলিত বন্দি’। ‘রোজার আধ্যাত্মিক দিক নিশ্চয় আছে। রোজা সংযম। রমজানের রোজা সমবেত সামাজিক সংযম। এর শিক্ষা ও কল্যাণের একাধিক দিক আছে’। সত্যিই! রমজানের কল্যাণের তুলনা হয় না। তাই তো রমজান মুমিনদের জন্য ইবাদতের বসন্তকাল। রমজানের এক চিলতে বাঁকা চাঁদ পশ্চিম আকাশে উদিত হওয়ার সাথে সাথেই মুমিন পাড়ায় শুরু হয়ে যায় পূণ্যের ব্যস্ততা। ব্যস্ততার দোল লাগে কবিদের পরাণেও। রমজানকে বরণ করে নিতে ছন্দপল্লবে সজ্জিত হয়ে ওঠে তাদের কলম-খাতা। ঠিক যেমন সজ্জিত হয়েছে কবি শাহাদাৎ হোসেন এর শুভ্র পৃষ্টারা। মাহে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘তোমারে সালাম করি নিখিলের হে চির কল্যাণ/জান্নাতের পূণ্য অবদান!।/যুগ-যুগান্তর ধরি বর্ষে আসিয়াছ চুমি/ধরনীর বনান্ত বেলায় অস্তসিন্ধুকূলে দূর প্রতীচীর নীলিমার গায়’। (রমজান)
রমজানে ছায়াময় যে প্রশান্তিতে জীবনের সকল ভুল-ভ্রান্তির ক্লান্তি মুছতে শতকোটি প্রেমিকের চোখযুগল ভিজে তপ্ত বারিধারায়, পূণ্যময়ী সেই দৃশ্য ফুটে ওঠে তাঁর এই কবিতায়। এই কবিতারই নিচের পঙ্কতিতে সেই দৃশ্য আরো গভীরভাবে ফোটিয়ে তোলেছেন তিনি এভাবে, ‘দ্বিতীয়ার পূণ্য তিথি প্রতি বর্ষে আঁকিয়াছে তোমার আভাস/দিক হতে দিগন্তরে জাগিয়াছে পুলকের গোপন উচ্ছ্বাস’।
রমজান মাস! শুদ্ধতার মাস। আত্মসংযমের মাস। সৌহার্দ সম্প্রীতি, পরোপকার, সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মাস। এই বার্তা নিয়েই রমজান আমাদের কড়া নাড়ে। সেই কড়া নাড়ার শব্দেরাই কবি ফজল-এ-খোদা’র কবিতার মাঠে ছন্দ তুলে দোলে ওঠে। কবি রমজানকে সংযমের বর্তিকা হিসেবে তুলে ধরে লিখেছেন, ‘হে রমজান হে রমজান!/দাও স্বস্তি দাও শাস্তি/ধরণীতে করো মনোরম/তোমারে হেরিয়া বিশ্ব বিবেক /সংযম হোক দুর্দম’।